চাকমা:
চাকমা / চাংমা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী বাংলাদেশের একটি প্রধান উপজাতি। চাংমারা বার্মার আরাকান রাজ্যে ডাইংনেট নামে পরিচিত । চাংমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধপূর্ণিমা ছাড়া তাদের অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব হচ্ছে বিজু। তাদের প্রধান জীবিকা কৃষি কাজ। জুম চাষের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন খাদ্যশষ্য ও রবিশষ্য উৎপাদন করে থাকে।
চাকমাদের নৃত্য (ছবি ইন্টারনেট) |
চাকমাদের উৎপত্তিকাল, আদি নিবাস ও
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের আগমন ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ষোড়শ শতকের আগের কোনো
সুস্পষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে নিশ্চিত বলা
যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের বসবাসের নজির
আছে। ১৭২৫ সালে চাকমাদের চট্টগ্রামে আগমনের ইতিহাস প্রমাণ্য হিসাবে আছে। অষ্টম
শতাব্দীর শুরুতে আপার অসমের ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তীতে চাকমা রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পক
নগর । সময়ের পরিক্রমায় চাকমা রাজতন্ত্রে নানা উত্থান-পতন ও বর্মা-মোগলদের
সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে চাকমাদের আবাসস্থল এবং রাজ্য শঙ্খ নদীর তীরবর্তী হাঙ্গরকুল ও
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া হয়ে উত্তর-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে ব্যাপ্ত
হয়।
ভাষাদক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশ ও নিকটস্থ ভারতীয় এলাকায় প্রচলিত একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। চাকমা জাতির লোকেরা মূলত প্রাচীন মগধ রাজ্যের সাক্য গোত্রের লোক। তাদের পূর্বসূরীরা বর্তমান বিহার-নেপাল সীমান্তের কাছে বাস করত। তারা আদিতে একটি তিব্বতি-বর্মী ভাষায় কথা বলত। কিন্তু কালের পরিসরে প্রতিবেশী চাটগাঁইয়া ভাষা চাকমা ভাষার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। চাকমা ভাষা নিজস্ব চাকমা লিপিতে লেখা হয়। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কথ্য ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ষ্পষ্টত: প্রমাণিত হয় যে, তা বাংলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষারই অপভ্রংশ। চাকমারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অপভ্রংশের মতো উচ্চারণ রীতি ব্যবহার করলেও চাকমা ভাষার বর্ণমালা বর্মী আদলে তৈরি। ব্রিটিশ আমলে কর্মরত চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মিঃ জিন বিসম ০৫ অক্টোবর ১৮৭৯ সালে রাজস্ব বোর্ডের নিকট লিখিত পত্রে উল্লেখ করেন, ‘‘ চাকমাগণ অর্ধ বাঙ্গালী। বস্ত্তত ইহাদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং ইহাদের ভাষাও বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ মাত্র। এতদ্ভিন্ন চাকমাদের উপাধি ভিন্ন নামগুলোও এমন বাঙালী ভাবাপন্ন যে, তাহাদিগকে বাঙালী হইতে পৃথক করা একরূপ অসম্ভব’’।
চাকমাদের বর্নমালা |
চাকমাদের ভাষার নামও চাকমা। চাকমাদের
নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। চাকমারা ৪৬টি গোজা ও বিভিন্ন গুথি বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত।১৯৯১
সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের সংখ্যা ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৭
জন।তবে বর্তমানে তা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। চাকমারা আদি বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী। তবে তারা বৌদ্ধ হলেও কেউ কেউ আবার প্রকৃতি পূজারীও। চাকমারা
জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। ক্রমাগত সৎকর্ম সাধনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়
বলে বিশ্বাস করে তারা।
উৎসব
চাকমাদের সবচেয়ে বড় জাতিগত উৎসব
বিজু। বাংলা বছরের শেষ দুদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করা হয়। বাংলা
বছরের প্রথম দিনকে বলা হয় ফুল বিজু এবং শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি বা
মূল বিজু। ফুল বিজুর দিন সকাল বেলা চাকমারা ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে
সাজায়, বুড়ো-বুড়িদের গোসল করায়, নতুন কাপড় দেয়। রাতে বসে পরের দিনের পাচন
তরকারি রান্নার জন্য সব্জি কাটতে বসে যা কমপক্ষে ৫টি এবং বেশি হলে ৩২ রকম সব্জির
মিশেলে রান্না করা হয়। পরের দিন মূল বিজু, এদিন চাকমা তরুণ-তরুণীরা খুব ভোরে উঠে
কলা পাতায় করে কিছু ফুল পানিতে ভাসিয়ে দেন। তারপর সবাই বিশেষ করে ছোটোরা নতুন
জামা-কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকে। তবে গ্রাম গুলোতে প্রাচীনকালের মতোন করে
ঘিলা খারা (খেলা) হয়। পরের দিন নতুন বছর বা গয্যে পয্যে, নতুন বছরের দিন সবাই
মন্দিরে যায়, খাবার দান করে, ভালো কাজ করে, বৃদ্ধদের কাছ থেকে আশীষ নেয়।
চাকমা লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধশালী।
তাদের লোক কাহিনীকে বলা হয় উবগীদ। চাকমাদের তাল্লিক শাস্ত্র বা চিকিৎসা
শাস্ত্র অনেক সমৃদ্ধ। আর বয়ন শিল্পে চাকমা রমণীদের সুখ্যাতি জগৎ জুড়ে।
একসময় জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল এ
জনগোষ্ঠী এখন নিজ প্রচেষ্টা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ
এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে তাই সহজেই
বিশেষভাবে পরিচিত চাকমারা। পার্বত্য চট্টগ্রাম যে তিনটি সার্কলে বিভক্ত এর অন্যতম
চাকমা সার্কল। বর্তমানে (২০১২) চাকমা সার্কলের চিফ বা চাকমা প্রধান হিসেবে খ্যাত
ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বর্তমান তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ
সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন